পরিশ্রম
Bright Sky
Writer : Shimanto Sarkar
পরিবারের প্রধান যখন সংসার ছেড়ে চলে জায় তখন সে পরিবারের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। ঘরের সঞ্চয় শেষ হয়ে জায়, চাউল ফুরিয়ে জায়। মা যখন মামার কাছে হাত পাতে মামা মুখ ফিরিয়ে নেয়। এভাবে ৬ মাস পার হওয়ার পর একদিন নানী মা কে ডেকে বললেন,
তুই আরেক জায়গায় বিয়ে বহই, এর এই ছোট পুলারে ওর বাপের কাছে রাইখা আহই। এই বেডা আর আইতো না মনে হয়। মা হাল ছাড়লেন না, তিনি বাবার রাগ ভাংগাতে চলে গেলেন দাদু বাড়িতে। যাওয়ার আগে মা কে বললাম, আব্বারে সঙ্গে আনার সুম আমার জন্য এডা সাইকেল কিনে আইনো। ঠিক আছে আসার সুম তর আব্বারে বইলে তর জন্য সাইকেল আনমুনি। এই বলে মা বাসা থেকে চলে গেলো দাদু বাড়িতে বাবাকে আনতে। বিকালে রাস্তায় ধারে বসে ঠোলামালি(মাটির হাড়ি পাতিল দিয়ে বাচ্চাদের খেলা) খেলতেছিলাম মামাতো ভাইবোনদের সাথে। এমন সময় মামাতো বোন বলে উঠলো, ওই দেক শিমু ফুপু আসতেছে(বিঃদ্রঃ আমাকে আদর করে সবাই শিমু ডাকতো)। দূরে তাকিয়ে দেখি মা এর শাড়ি দেখা যাচ্ছে মুখ স্পষ্ট নয়। তবে আম্মার শাড়ি দেখেই আমি বুঝতে পেরেছি সেটা আমার মা। তবে বাবা কোথায়?
মা কাছে আসলো, দেখি উনার শাড়িতে মাটি লেগে আছে। জিজ্ঞেস করলাম, আম্মা আমার সাইকেল কই? মা কোন জবাব দিলো না। নানী আসার পর মাকে জিজ্ঞেস করলো, কি হইছে মনু? তর চেহারা কাপরের এই অবস্থা কেন? মা ফুপিয়ে কাদতে লাগলেন। অতপর বললেন যে তাকে মারধর করে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে আমার বাবা। উনার সাথে আমার চাচা জেঠা তাদের স্ত্রী সন্তানগন উনাকে ঘাড় ধরে বের করে দেয়। আর বলে দেয় আমাকে জেন তাদের কাছে দিয়ে আসে আর আমার বাবার সাথে জেন কোন প্রকার সম্পর্কের চেষ্টা না করে।
আমি নিরব হয়ে সব কথা শুনতে লাগলাম। কিছু কথা বুঝতে পারলাম কিছু পারলাম না।
সাল ২০১০ মা সংসার চালানোর জন্য তামাকের কারখানায় চাকুরি নিলেন। দৈনিক বেতন ৫০৳। সংসার চালানোর জন্য এই টাকা খুবই সামান্য। তবুও টানা পোড়ার মধ্যেই দিন চলতে লাগলো। আমিও স্কুলের পাশাপাশি মাকে তামাকের বিড়ি বানানোর কাজে সহায়তা করতে লাগলাম। এক সময় আমারো বেতন হয়ে গেলো ২৫৳। যখন ৫ম শ্রেনিতে পরতাম তখন স্কুল ছিলো হাফ বেলা দুপুর ১২ টা থেকে বিকাল ৪ টা অবধি। আমি তখন সকাল ৭ টায় কারখানায় জেতাম দুপুর সকাল ১১ঃ৩০ এ বাসায় চলে এসে ব্যাগ কাধে নিয়ে স্কুলে চলে জেতাম। স্কুলেও হলার তিরস্কারের স্বীকার। গায়ে ময়লা রঙ উঠে যাওয়া শার্ট। সহপাঠিরা ময়লা শার্ট নিয়ে আমাকে ভেঙ্গাতে লাগলো। নতুন শার্ট কেনার টাকা নেই। ব্যাঞ্চের এক কোনায় বসে ক্লাস করতে লাগলাম। জেন ম্যাডামের চোখে তেমন না পরি। যেখানেই বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়, ম্যাডাম ঠিক আমার কাছে আসলেন, আসার পর মাথার চুল ধরে দাড় করালেন আমাকে, হো হো করে পুরো ক্লাসে হাসির রোল পড়ে গেলো আমার এই অবস্থা দেখে।
এই ছেলে তুমার চুলের এই অবস্থা কেনো? এত বড় বড় কেন? চুল কাটো না? নতুন শার্ট কই ? অতঃপর তিনি কেচি এনে মাথার চুল গোড়া থেকে কিছুটা কেটে দিলেন। জেন সেলুনে গিয়ে চুল কাটতে হয়। কারণ এই অবস্থায় বাইরে গেলে মানুষ হাসাহাসি করবে। তিনি চুল কেটেও ক্ষেন্ত হন নি। কেচি দিয়ে শার্টের পেছনে বেশ লম্বা করে কেটে দিয়ে বললেন, কাল থেকে চুল কেটে স্কুলে আসবা আর নতুন স্কুল ড্রেস বানাবা।
চোখ বেয়ে পানি পড়ার মতো অবস্থা, চুল কাটতে ৫০৳ নতুন স্কুল ড্রেস বানাতে ৩০০ টাকা এত টাকা পাবো কোথায়? মা প্রতিদিন আয় করেন ৫০ টাকা আমি আয় করি ২৫ টাকা। দিন আনি দিন খাই। প্রতিদিনের রেগুলার খাবার হয়ে গেছে আধা কেজি চাউল ১০ টাকার মসুরের ডাল এক পোয়া পেয়াজ আর আলু ভর্তা। প্রতিদিন ডাল ভাত আর আলু ভর্তাই আমাদের রেগুলার খাবার। কোন দিন বিল থেকে ছোট পুটি মাছ কিংবা টাকি মাছ ধরলে মা ভর্তা কিংবা তরকারি রাধেন। কোন দিন ভালো মন্দ খেতে চাইলে মা মাছ চাল ডাল সব একাকার করে খিচুরি রাধেন। ছেড়া শার্ট আর কেটে যাওয়া চুল নিয়ে হাটতে লাগলাম। সহপাঠিরা আমার ছেড়া শার্টে আংগুল ঢুকিয়ে আরো ছিড়ে দিলো। এ দেখে বাকিরা রাস্তায় হাসতে হাসতে শেষ। এভাবেই বাড়ি চলে আসলাম।
রাতে মা কাজ শেষ করে যখন বাসায় আসে তখন মা কে সব জানালাম। মা চোখের পানি ফেলতে লাগলো, অতপর তিনি সুচ এনে আমার শার্টের পেছন দিক টা সেলাই করতে লাগলেন। তারপর ব্লেট দিয়ে মাথা নেড়া করে দিলেন। চুল কাটার ঝামেলাই শেষ।
নেড়া মাথা নিয়ে পরদিন স্কুলে গেলাম। সবাই হো হো করে আবার হাসতে লাগলো। আমাকে জাম্বুরা, টাকলা, স্টেডিয়াম ইত্যাদি বলে খেপাতে লাগলো। ম্যাডাম আমার আগের শার্ট আর চুল নেড়া দেখে আমাকে বললেন কাল তুমার বাবা কে স্কুলে আসতে বলবা। আমি বললাম বাবা মারা গেছে। ম্যাডাম চুপ হয়ে থাকলো কিছুক্ষণ তারপর বললো তুমার মা কে স্কুলে আসতে বইলো।
পরদিন মা স্কুলে গেলেন, মা কে প্রশ্ন করা হলো ছেলের চুল না কেটে নেড়া করে দেওয়ার কারণ ? অতঃপর ম্যাডামকে মা সব খুলে বললেন।
পরদিন ম্যাডাম আমাকে ক্লাস থেকে ডেকে এনে অফিস রুমে নিয়ে গেলেন। তারপর আমার হাতে আকাশী রঙের একটা শার্ট দিয়ে বললেন কাল থেকে এই শার্ট পরে স্কুলে আসতে। আমি শার্ট টা নিয়ে বাসায় চলে গেলাম। উপহার নাকি দান? এই ভাবতে ভাবতে বাসায় চলে আসলাম। পরদিন আর শার্ট পরলাম না। ম্যাডাম আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি শার্ট টা পড়ে আসিনি কেন। আমি কেন আগের পুরাতন সেই স্কুল ড্রেস টা পরেই স্কুলে এসেছি। আমি কিছু বললাম না, মাথা নিচু করে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলাম। বুড়ো আংগুল দিয়ে মেঝে খুচাচ্ছিলাম এক মনে। হয়তোবা সেদিন ম্যাডাম বুঝতে পেরেছে, মানুষ অভাবে পরলেও দান নিতে আগ্রহী হয় না সবাই। তিনি আমাদের পূর্বের আর্থিক অবস্থা সমন্ধে অবগত ছিলেন হয়তোবা।

মন্তব্যসমূহ