স্কুলের দিনগুলি
স্কুলের দিন গুলো
Bright Sky
Part:03
এখনো স্পষ্ট মনে আছে যখন আম্মার আংগুল ধরে প্রথম প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হতে গেলাম, চুল আচড়িয়ে টাং থেকে নতুন কাপড় পরে স্কুলের দিকে হেটে হেটে রউনা দিয়েছিলাম। আম্মা বার বার বলতে লাগলেন ম্যাডাম কিছু জিগাইলে উত্তর দিবি ব্যা ব্যা করে কানবিনা। আমি অবশ্য অল্পতেই কান্না করে ফেলতাম। সমবয়সী কিংবা গুরুজনেরা আমাকে ফেতকান্দুরা বলে খোচা দিত।
স্কুলে ঢুকে আম্মার সাথে অফিস-রুমের দিকে অগ্রসর হলাম। বুক প্রচন্ড্র ধুক ধুক করতেছিল। মেঝ ভাইকে দেখেছি প্রায় সময় হাতের তালু লাল করে বাসায় আসতো। জিজ্ঞেস করার বলতো, ম্যাডাম মারছে। সেই ছোট মস্তিষ্ক তখনই খুব ভয় পেত স্কুলের জীবন নিয়ে। না জানি কত মারে। ঘরে ভুল করলে বাপে মারে স্কুলে ভুল করলে আরেক জন মারবে।
যখন অফিসরুমে ঢুকি দেখি কাঠের চেয়ারে মস্তবড় একটা শরির শাড়ি গায়ে জড়িয়ে কাচের সাদা চশমা পড়ে বসে আছে। আমার দিতে তাকিয়ে আম্মাকে বললেন সামনের চেয়ারে বসতে। মহিলাটা বার বার আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমি তো ভয়ে একাকার হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। এই বুঝি লাঠি দিয়ে হাতে বারি দিলো। তখন কি আর জানতাম উনি আমার বয়স আর উচ্চতা দেখে আন্দাজ করতেছেন যে আমি স্কুলে ভর্তি হওয়ার মতো কিনা। উনার বাকা চোখে তাকানোর ভংগি দেখে আমি আম্মার শাড়ির আচল খামচে ধরলাম।
অত:পর উনি আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন, উনার জিজ্ঞেস করায় আমি চুপ চাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। মুখ দিয়ে একটা আওয়াজ ও করলাম না। আম্মা আমাকে বার বার বলতে লাগলো বাবা নাম বল তুমার!
এক সময় ভ্যা করে কান্না শুরু করে দিলাম। আমার কান্না আর থামায় কে। একবার শুরু করলে রেডিওর মতো এক টানা বাজতেই থাকি।
অবশেষে ভর্তি করে নিল, তবে স্কুলের যাওয়ার প্রতি আমার কোন লক্ষ্মণ নই দেখা গেল না। সকালে ঘুম থেকে উঠেই লাপাত্তা, আমাকে আর খুজে পায় কোথায়। এভাবে ১ থেকে দেড় মাস কেটে যাওয়ার পর বাবা বাড়িতে আসলে। আম্মা দিলেন আমার নামে নালিশ। ভাবলাম আজ বুঝি আমার রক্ষে নেই। বাবা খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমারে বললেন স্কুলের ড্রেস পর বেগ গুছাও। আমি কোন প্রতিউত্তর কিংবা অনিহা দেখানোর সাহস পেলাম না। অজ্ঞতা বেগ গুছিয়ে বাবার সাথে রউনা দিলাম।
যখন স্কুলে জাই তখন প্রায় দুপুর আর একটু পর স্কুল ছুটি হবে বৈকি। ক্লাস রুমের দরজার সামনে গিয়ে দেখি সেই মোটা শরিরের মহিলাটা পড়াচ্ছেন। আব্বা উনার সাথে ২-১ আলাপ করে আমাকে স্কুলের বেঞ্চে বসিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।
কিছুক্ষণ বাদে বেল বাজা শুরু হলো। একে একে সবাই বাইরে বের হয়ে গেল। আমার সাথে অবশ্য আমার প্রতিবেশি সমবয়সী অনেকেই ছিলো। তবে আমি যে অতি ভয় আর চুপ চাপ ছিলাম তারা তেমন ছিলো না। হৈ হুল্লোড় করে এমন ভাবে ক্লাস মাতিয়ে রেখেছিলো যে মনেই হয় না তারা আমার মতো নতুন।
এভাবে ১ টা বছর কেটে গেলো, মনে আর ভয় কাজ করে না। ক্লাসে পড়া দিতে পারলে মেডাম সবাইকে দিয়ে হাততালি দেওয়াই। খুব ভালো লাগে। এতে আরও পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী হয়ে গেলাম। সন্ধায় ১-২ ঘন্টা পরে আবার ফজরের আজানের শব্দে ঘুম থেকে উঠে জোরে জোরে আওয়াজ করে পরতাম। পরদিন সকাল বেলা আমার প্রতিবেশি বন্ধুর আম্মা আমার বন্ধুকে বকাবকি করতো। আর আমার প্রশংসা করত। এ দেখে আমি আরও জুরে জুরে আওয়াজ করে পরতাম।
আকাশি কালার শাট, গাড়ো নিল হাফপেন্ট, গলায় রাবার দিয়ে বাধা টাই, কপালে এক পাশে পাতিলের নিচের কালি দিয়ে বসানো টিপ, আবার নারিকেল তেল দিয়ে চুপ চুপে ভেজানো চুল আচড়িয়ে স্কুল যেতাম। কখনো বা বই এর পাতায় মানুষ গুনে গুনে খেলাধুলা করতাম। জোড় পাতা আমার বিজোর পাতা বন্ধুর। জার পাতায় জত বেশি মানুষ থাকবে সে তত বেশি কিল খাবে পিঠে।
প্রতিদিন স্কুলে দুধের প্যাকেঠ আর বিস্কিটের প্যাকেট পেতাম। সেই লোভে আমরা কেহই স্কুল কামাই করতাম না। দুপুরে স্কুল শেষ করে মাঠে ঘুড়ি ওড়ানো, বৃষ্টির নতুন পানিতে ঘেনর ঘেনর করা ব্যাঙ এর উপর ঢিল ছুড়ে মারা, কিংবা অল্পতেই বন্ধুদের সাথে নখ দিয়ে আচড় কেটে মারামারি করা এসব করেই পুরো শৈশব কাটিয়ে দিলাম। যখন সন্ধায় কারেন্ট চলে যায়, কারেন গেছেগা বলে এক নাগাড়ে সবাই চিল্লায়ে বলে উঠতাম। তখন সবাই বাইরে এসে পূর্ণিমার চালের আলোয় সুন্দর রাত উপভোগ করতাম৷ অনেকে গল্প জুড়ে দিত,আমরা ছোট রা হৈ হৈ করে পুরো এলাকা দৌড়ে দাপিয়ে বেড়াতাম।

মন্তব্যসমূহ