পিতা পুত্রের বিচ্ছেদ
Bright Sky
Writer : Shimanto Sarkar
সাল ২০০৯
স্বামী স্ত্রীর মাঝে জগরা হয় এটা সামাজিক একটা প্রথার মতো হয়ে গেছে, জগরা ছাড়া কোন
পরিবার নেই তবে সে জগরা যদি হয় অনেক বড় তাহলে পুরো পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়। জীবন স্থির
হয়ে যায়। ছেলেটির বড় ভাই অল্প বয়সে প্রেম করে বিয়ে করে ফেলে পরিবারের সম্মতি ছাড়াই।
পরিবারের অমতে বিয়ে করায় পরিবার তাকে বাসা থেকে বের করে দেয়। বাধ্য হয়ে বড় ভাই পাশের
জেলায় গিয়ে রাজমিস্ত্রির কাজ শুরু করে দেয়, আলাদা ছোট ঘর নিয়ে সে তার সংসার জীবন শুরু
করে দেয়। পরিবারের সাথে কোন যোগাযোগ রাখে না। পরিবার তার উপর রাগান্মিত হয়ে তাঁকেও
আলাদা হিসেবেই ধরে রাখে। তবে মায়ের অবুঝ মন মানে না, তিনি গোপনে তাহার বড় ছেলের সাথে
যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করে।
ছেলেটি স্কুলে
যাওয়ার সময় দেখে তার পিতা এবং মাতা প্রতিদিনের মতো ঝগড়াতেই লিপ্ত আছে, সে তার ব্যাগ
গুছিয়ে একা একাই রেডি হয়ে স্কুলের দিকে রউনা দেয়। ভেবেছিলো তার মা আজ তাকে সকালে ভাত
বেরে খাওয়াবে মাথার চুল আচরে দিবে। সে ভাগ্য আর হবে না। মা নিশ্চুপ হয়ে কান্না করছে,
বাবা বেধম মারধর করছে।
স্কুল থেকে
ফিরে এসে দেখে বাবা বাসায় নেই। মা বিছানায় শুয়ে কান্না করছে। ছেলেদের দাদার বাড়িটি
একদম গ্রাম অঞ্চলের দিকে সেখানে বিদ্যুৎ এর সুবিধে নেই স্কুল কলেজ অনেক দূরে, তাই তার
মা স্বামী বাচ্চা সহকারেই বাপের বাড়িতে থাকতেন। তবে পিতা মাঝে মধ্যেই গ্রামের বাড়িতে
গিয়ে উনার মাকে দেখাশোনা করে আসতো। মাকে বাবার কথা জিজ্ঞেস করায় মা বললেন, বাসা থেকে
তার বাবা রাগ করে তার মেঝ ভাই কে নিয়ে দাদার বাড়িতে চলে গেছে। আমাকেও নিতে চেয়েছিলো
তবে আমি স্কুলে ছিলাম বিধায় আমার মেঝ ভাইকেই সাথে করে নিয়ে গেছে। এমন টা প্রায় ই হয়,
কতবার বাবা রাগ করে চলে গেলো কতবার ফিরে আসলো তার ইয়োত্তা নেই। আবার দেখা যাবে দুদিন
পর ঠিকি ফিরে আসবে।
এক দিন যায়
দুদিন যায় পিতা আর ফিরে আসে না, এদিকে মেঝ ভাই নেই বড় ভাই নেই বাড়িতে একা একা সময় পার
করে বালক টি। ঘরে ভাতের চাল ফুরিয়ে এসেছে, টা টাকা ছিলো তোশকের নিচে তাও শেষ। বাধ্য
হয়ে এবার মা নিজেই গেলো তার স্বামীকে ফেরত আনতে। প্রতিবার বাবা যখন বাড়িতে আসে রাগ
শেষে হাতে কত কিছুই আনে আমাদের জন্য, কিন্তু এবার মা একা ফিরে আসলো। উনার শাড়িতে মাটি
লেগে আছে, চেহারায় আঘাতের ছাপ বসে আছে, গলার আওয়াজে কান্নার সুর। মামা বললেন থাক তাকে
আর ফেরত আনতে হবে না। পুলা ছোট টারে তারে দিয়ে তুই আলাদায় জায়গায় বিয়ে করে নে। প্রতিবার
একি হুজুক পাইছে দুলাভাই।
কি জন্য মায়ের
এই অবস্থা আমি জানি না, কি হয়েছে তাও বলতে পারি না। তবে সেদিনের অবস্থা দেখে বুঝলাম
পিতা আর আসতে রাজি না।মা অবশেষে তামাকের কারখানার কাজ নিয়ে নিলো। প্রতিদিন বেতন ৫০
টাকা করে। ১-২-৩-৪ দিন বাপের বাড়ির সাহায্য পেলেও দিন শেষে তারাও মুখ ফিরিয়ে নিলো।
বাধ্য হয়ে এই মহিলা আর ২য় বিয়ে করলো না। ছোট্ট এই ছেলেটাকেই বুকে জড়িয়ে ধরে জীবন যুদ্ধে
লেগে গেলো। কথায় আছে এই দুনিয়ায় সব চাইতে বড় যোদ্ধা হচ্ছে মা।
ছেলেটি প্রতিদিন
স্কুল শেষ করে বাসায় এসে দুপুরের রান্না করতে থাকে, রাতে মা রান্না শিখিয়ে দেয় কিভাবে
করতে হয়, তবুও নুন মরিচ তেল তনুপাত করে না দিতে পায়ার তরকারি যে সে অবস্থা হয়ে যায়।
মা কিছু বলে না, ছেলেকে বলে খুব সুন্দর রান্না হয়েছে। কেননা উনাকে ভোর ৫ টায় কাজে যেঁতে
হয়। সকালে মা ছেলে দুজনেই না খেয়ে কাজে স্কুলে যায়, রাতে মা রান্না করে। দিনে মাত্র
৫০ টাকা দিয়ে সংসার চলে না। প্রতিদিন আধা কেজি চাইল, একটা ডিম কিংবা ডাল দিয়েই তাদের
পরিবার চলে। তবে তারা কারো কাছে সাহায্যের জন্য যায় না। লজ্জা আত্মসম্মান সব চাইতে
বড় কথা। একদিন বাচ্চা ছেলেটি তার মাকে বললো, আম্মা আমি ক্লাস শেষ করে তুমার সাথে কাজ
করবো এক সাথে কাজ করলে কিছু বাড়তি টাকা পাবো। পড়াশোনা করতেও টাকার প্রয়োজন যদিও সরকারি
স্কুল তবুও টাকা ছাড়া পড়াশোনা অসম্ভব। মা রাজি হলেন দুপুরে স্কুল শেষ করে ছেলেটিও কারখানাতে
যাওয়া শুরু করলো।
কারখানার
ভেতর বিড়ি বানানো হয়, তামাক পাতা গুড়ো করে অনেক টা সিগারেট এর মতো সাদা কাগড়ে মুড়ে
বানানো হয়। তামাকের গন্ধ্য ছেলেটির পছন্দ না, তবুও সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই, আস্তে আস্তে
সব সয়ে গেলো। ভেতরে প্রায় ২৫০ জন মহিলা কাজ করে তাদের মাঝে অল্প বয়সি বাচ্চারাও কাজ
করে। কাগজের ভেতরে তামাক পাতা ঢোকানো। প্রতি হাজারে ২৫ টাকা করে পাওয়া যেত। জারা অভিজ্ঞ
তারা দিনে ১২-১৩ হাজার বিড়ি বানাতে পারতো।ছেলেটি আর তার মা নতুন বিধায় তারা দিনে ২
হাজার কিংবা আড়াইহাজার বিড়ি বানাতে পারে জা তাদের প্রতিদিন ৭৫ টাকা আয় করতে সক্ষম হয়।
পিতা প্রতিদিন
তার ছেলেদের ১০০ টাকা পয়েট খরচ দিতো স্কুলে যাওয়ার জন্য, বড় দুই ভাই ৪০ টাকা করে নিত
আর ছোট ছেলেকে ২০ টাকা ভাগ দিতো। আর আজ তাদের সংসারের জীবিকার আয় মাত্র ৭৫ টাকা। মা
তার ছোট এই ছেলেকে বলতে লাগলো কেউ যদি জিগ্যেস করে তুমার বাবা কোথায় বলবে যে মারা গেছে।
ছেলেটি মায়ের কথা মোতাবেক চলতে লাগলো। মা হয়তো অনেক অভিমান করেই তার নিজ স্বামীকে মৃত
হিসেবেই মনে করতে লাগলো ছেলেকেও সেদিকেই ভাবাতে বা বিশ্বাস করাতে লাগলো। যখন সম্পকের
ফাটল ধরে যায় তখন আর হিতাহিত জ্ঞান কাজ করে না। যখনই ছেলেটিকে কেউ জিগ্যেস করে তুমার
বাবা কই ছেলেটি সরল গলায় বলে মারা গেছে। লোকে তাই বিশ্বাস করা শুরু করে দিলো।
একদিন পিতা
তার ছোট ছেলেকে নিতে তার শশুড় বাড়ির এলাকায় আসলো, কতিপয় এক লোক পিতার সম্মুখীন হওয়ায়
অবাক হয়ে গেলো। তিনি ধরেই নিয়েছেন এই লোক বুঝি আসলেই মারা গেছে। তিনি পিতাকে বলতে লাগলেন
আপনি বলে মারা গেছেন। পিতা হেসে জবাব দেয় মারা গেলে কি আর আপনার সামনে থাকি নাকি মিয়া।
কি কন এইসব? আপনার স্ত্রী আপনার ছোট ছেলেই তো বলে বেড়াচ্ছে আপনি মারা গেছেন। পিতা থ
হয়ে রাস্তায় দারিয়ে রইলো, তাকে এভাবেই পর করে দিয়েছে তার স্ত্রী তার সন্তান, রাগে অভিমানে
দুঃখে তিনি আর শশুড় বাড়িতে গেলেন না। তিনি তার ছোট সন্তান আর স্ত্রীকে ভুলে নিজের গ্রামেই
চলে গেলেন।

মন্তব্যসমূহ