শোধ প্রতিশোধ
শোধ-প্রতিশোধ
শশাংকের মৃত্যুর পর বাংলার ইতিহাসে এক দুর্যোগপূর্ণ অন্ধকারময় যুগের সূচনা হয়। দীর্ঘদিন বাংলায় কোন যোগ্য শাসক ছিলেন না। ফলে, রাজ্যে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা দেখা দেয়। একদিকে হর্ষবর্ধন ও ভাস্করবর্মণের হাতে গৌড় রাজ্য ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়, অন্যদিকে ভূ-স্বামীরা প্রত্যেকেই বাংলার রাজা হওয়ার কল্পনায় একে অন্যের সাথে সংঘাতে মেতে উঠে।
৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে যুদ্ধে হেরে যাওয়া এক ছিন্ন ভিন্ন যোদ্ধাদের একটি দল দক্ষিণ বাংলার একটি গ্রামের উপর দিয়ে পালাতে লাগলো। ২০ জনের এই দলের সবাই ঘোড়া ছুটিয়ে গ্রামের ভেতরে ঢুকতেই তারা লুটপাত শুরু করে দিলো। সোনা গহনা চাল ঢাল যুবতি নারী এবং প্রয়োজনীয় যে সকল কিছু তাদের পলায়নের জন্য প্রয়োজন তা সবি সে গ্রাম থেকে লুট করে নিতে থাকলো। গ্রামের যে সকল যুবক বাধা দিতে এসেছিলো তাদের তরবারি আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন করে দেওয়া হলো। পুরো গ্রামে মহিলা শিশুর কান্নায় একাকার হয়ে গেলো। আতঙ্ক বাড়িতে দেওয়ার জন্য তার ছনের ঘর গুলোতে আগুন লাগিয়ে দিলো। অনেকে গ্রামের বাইরের দিকে পালাতে লাগলো কেউ বা ব্যস্ত ছিলো আপন পরিবারের মানুষের খোজায় কিংবা তাদের মৃতদেহ পাশের বসে কান্না করায়।
এই দলের একজন নতুন যোদ্ধা শঙ্কচন্দ্র রায় তার কালো রঙের ঘোড়ার উপর বসে তাকিয়ে দেখছিলো তাহার সহযোদ্ধারা কিভাবে সব লুটপাত করে নিচ্ছে। তার এই লুটপাত সমন্ধে কোন ধারণা ছিলো না। এক যোদ্ধা গলা হাকিয়ে বলতে লাগলো, ওহে যুবক এভাবে তাকিয়ে থেকে লাভ নেই, যদি প্রাণে বাচার ইচ্ছা থাকে তাহলে লুট করে নাও, কেননা আমরা যুদ্ধে হেরে গেছি, এতক্ষণে আমাদের রাজ্য দখল হয়ে গেছে। আমাদের ফেরার পথ নেই। পরিবার নিয়ে ভেবে লাভ নেই হয় তাদের মেরে ফেলা হয়েছে কিংবা তুমার স্ত্রী বোনদের তারা ভোগ করা শুরু করে দিয়েছে।
শঙ্কচন্দ্র ভেবে পায় না যে বিজয় পাওয়ায় যদি তারা তার পরিবারের মেয়েদের উপর এভাবে এমন অত্যাচার করে, তাহলে তারা হেরে যাওয়ায় যে এই গ্রামের উপর লুটপাট শুরু করে দিয়েছে তাদের মাঝে তফাৎ কি? হেরে গেলেও ভোগ করো অন্যায় ভাবে জিতে গেলেও ভোগ করো একি রকম ভাবে। এখন যেহেতু তার নিজ জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয় সেহেতু জীবন বাচিয়ে রাখার জন্য তাহাকেও তাহার সঙ্গীদের মতো লুটপাট করা ছাড়া উপায় নেই।
সে তার ঘোড়ার পিঠে এক বস্তা আটা আর কিছু তেল নুন মরীচ নিয়ে নিলো, হাতে কিছু নগদ টাকার জন্য ঘরের সিন্দুকে রাখা কিছু পয়সা নেওয়ার সময় পেছন থেকে এক বুড়ো বড় দা দিয়ে আঘাত করতে আসলে শঙ্কচন্দ্র তার বকে তরবারি ঢুকিয়ে দেয়। তাজা রক্ত গুলো তর তর করে বেরোতে লাগলো। শঙ্কচন্দ্র যুদ্ধের ময়দানে কাউকে হত্যা করতে পারেনি, তবে তরবারি যুদ্ধে ২-১ জন শত্রু আঘাত পেয়েছে মাত্র। এই প্রথম সে তার নিজ হাতে কাউকে হত্যা করলো। সিন্দুক থেকে কিছু মোহর নিয়ে যখন সে তার ঘোড়ার দিকে এগোচ্ছে তখন সে দেখতে পায় খড়ের গাদার পাশে এক সুন্দরী তরুণী লুকিয়ে আছে। মায়াবী চোখ লম্বা ঘন চুল প্রায় পিঠের শেষ অংশে ঝুলে আছে। এত সুন্দর রমণী রাজ্যের রাজ মহলেও জন্মায় বলে সন্দেহ। ভালো সাজগোজ করিয়ে যদি তাহাকে রাজকুমারী বলে অবিহিত করা হয় কেহ সন্দেহ করবে বলে মনে হয় না। কথায় আছে না গোবরে পদ্মফুল ফোটে। ঠিক তেমনি এই অজপাড়াগায়ে এই কুড়ে ঘরেই এমন রমণীর জন্ম। সকল যোদ্ধা প্রয়োজনীয় রসদের পাশা পাশি একটা করে নারী তাদের ঘোড়ায় তুলে নিচ্ছে সেহেতু তার ও কাউকে অপহরণ করা উচিৎ। তবে এই যুবকের মনে এমন কোন চিন্তা হচ্ছে না। সে এখনো তার পরিবারের উপর কি হচ্ছে তা নিয়ে চিন্তিত। এমন সময় পাশ থেকে এক সৈন্য বলে উঠলো কিহে শঙ্কচন্দ্র রমণীটা কে তুমি নিবে নাকি আমিই নিয়ে নিব। রমনি আপনা থেকেই বললো আমি উনার সাথে যাবো। শঙ্কচন্দ্র ভেবে পায় না যেখানে মেয়েদের জোর করে তুলে নেওয়া হচ্ছে সেখানে এই রমনি আপনা থেকেই তার সাথে যেতে ইচ্ছুক কেন? বাস্তবতা হচ্ছে রমনি মানা করলেও উপায় ছিলো না। পাশের সৈন্য ঠিকি তাকে অপহরণ করে নিবে। অপরিকে লুটের মালের সাথে রমণী না থাকলে শঙ্কচন্দ্র তার দলের নিকট বেশ লজ্জিত থাকতো। মেয়েকে ঘোড়ার সামনে তুলে নিয়ে বাকি দলের সাথে এগোতে লাগলো পাহাড়ে দিকে।
রবিচন্দ্র রায়ের মৃত্যুর পর রায় পরিবারের অবস্থার অবনতি ঘটে। ধার ঋণের কবলে পড়ে পরিবারের সম্মানের পাশা পাশি চাল ডাল ও ফুরিয়ে গেছে। বাইরে থেকে দেখা জায় বিশাল পাকা পোক্ত বাড়ি, চারিদিকে ইটের উচু দেওয়াল, বাড়ির পাশে পুকুর, পুকুড়ের ধারে মন্দির। বাইরে থেকে ছোট জমিদার বাড়ি মনে হলেও ভেতরের বাস্তবতা ভিন্ন। রায় বংশের মানুষ তাদের অভাব অনটন প্রকাশ না করলেও যে প্রতিবেশি মানুষ তা জানেনা এমন না। সবাই জানে পুরো পরিবার মাকাল ফল হয়ে গেছে। বাইরে চক চক করলেও ভেতরে যে একেবারে শেষ তা আর বলতে হয় না।
পিতামহ মারা যাওয়ার পর শঙ্কচন্দ্র রাজবাড়িতে গৃহ শিক্ষক এর চাকরি নেয়। যখন প্রতিবেশি রাজ্য আক্রমণ শুরু করে তখন অধিক টাকার লোভে সৈন্য দলে যোগ দেয়। একে তো জয়ী হলে রাজ মহল থেকে সোনা দানা পাওয়া যাবে তার উপর আবার লুটের সম্পদ। সে ভেবেছিলো এ হলে বুঝি তার পরিবারের আগের অবস্থা ফিরিয়ে আনতে পারবে। বোন টাকে ভালো পরিবার দেখে বিয়ে দিতে পারবে। পিতামহের জমিদারী আবার ফিরিয়ে আনতে পারবে। তবে ভাগ্য তাহাকে এমন দিকে নিয়ে যাচ্ছে সেখানকার ভবিষ্যৎ কি তা জানে না। পরিবারের কথা ভেবে লাভ নেই। তাদের উদ্ধার করা সম্ভব নয়। উলটো নিজের জীবন যাবে বৈকি তাদের অবস্থার পরিবর্তন হবে না।
গ্রাম পার হয়ে তারা দুই পাহাড়ের মাঝে বড় ঝর্ণার ধারে তাবু ফেললো। শঙ্কচন্দ্র একটু ঝর্ণার ধারেই তার তাবু ফেললো। মেয়েটি তার সাথে তাবু ফেলাতে সহায়তা করলো। বাকি সৈন্য তাবু ফেলার চাইতে ধরে আনা রমণীদের ভোগ করাতেই বেশি ব্যস্ত ছিলো। মেয়েটি ভয় ভয় চোখে শঙ্কচন্দ্র দিকে তাকিয়ে আছে। শঙ্কচন্দ্র এই চোখের চাহনির মাঝে আতঙ্ক বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার নাম কি?’
পহেলিকা
অতঃপর দলের প্রধান সবাইকে ডাক দিলেন, এক যোগে সবাই দলের প্রধানের কাছে গিয়ে দাড়ালো।
“আমরা যুদ্ধে হেরে গেছি, আমরা আর ফিরতে পারবো না। আমরা এক যোগে দল বেধে আর লোকালয়ে ভিড়তে পারবো না’’ আমাদের পরিবারকে তারা গোলাম বানিয়ে ফেলেছে, আমাদের পেলে গর্দান উড়িয়ে দেবে। সুতরাং আমাদের এই দুই পাহাড়ের পাদদেশে থাকা ছাড়া আর উপায় নেই। সুতরাং পরবর্তী সিন্ধান্ত নেওয়ার আগে এখানকার পরিস্থিতি সাভাবিক রাখা উচিৎ। এরপর দুই পাহাড়ের চুড়ায় ৩ জন কে রাতে ৩ জন কে দিনে পাহাড়া দেওয়ার জন্য বলা হলো। আর বাকিরা নিচে বাসস্থান বানানো জঙ্গল সাফ করা ইত্যাদী কাজ করবে। শঙ্কচন্দ্র কে দেওয়া হলো রাতে দক্ষিনের পাহাড়ের চুড়ায় পাহারা দেওয়ার কাজ।
সেদিন রাতে প্রতিটি তাবু থেকে মেয়েদের কান্নার গলা আর চিৎকার ভেসে আসলো। তার যে জার মতো ভোগ করতে থাকলো মেয়ে গুলোকে। পহেলিকা শুধু ভাবছে যে সে জার সাথে আসছে সে কখন তার উপর আক্রমন শুরু করে দেয়। সে নিজ থেকে না আসলেও উপায় ছিলো না, সে দেখেছে তাহার গ্রামের মেয়েদের কিভাবে চুলের মুঠি ধরে তুলে নিয়েছে। শঙ্কচন্দ্র তাহাকে না নিলে পাশের সৈন্য ঠিকি মারধর করে তুলে নিতো। বাকিদের চাইতে শঙ্কচন্দ্র কে দেখে বালিকার মনে হয়েছে এ যুবক অতি কোঠর না। তাই বাধ্যহয়ে নিজ থেকেই বন্দিশালা গ্রহণ করে নিয়েছে।
শঙ্কচন্দ্র বাকি সৈন্যদের মতো না, যুদ্ধের রীতিনীতি সমন্ধে তার ধারণা নেই। তার মতে জোর জবরদস্তী করে নারিকে ভোগ করা বড় অন্যায়। সে পহেলিকা কে তাবুতে থাকতে বলে শঙ্কচন্দ্র ঝর্ণার ধারে পাথরের উপর বসে রইলো। ঝিরিঝির আওয়াযে মেতে আছে উপত্যকা, পায়ের নিচে ঠান্ডা শিতল পানি। আকাশের পূর্ণিমার আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন আর তাবুর নারীদের করুণ কান্নার আওয়াজ তার কানে আসে না। নুপুরের আওয়াজে পেছনে ঘুরে দেখলো পহেলিকা দাঁড়িয়ে আছে। দুহাত দিয়ে হাতের কবজি ধরে মাথা নিচু করে ভয়ার্ত গলায় বলতে লাগলো তাবুতে ঘুমাতে ভয় হচ্ছে, মনে হয় কেউ তাকে জোর করে তুলে নিবে। শঙ্কচন্দ্র বলতে লাগলো, আমিও তো তোমাকে অপহরনি করেছি, ভয় পেয়ে আমার কাছে এসেই কি লাভ আমিও তো তাদেরি একজন। পহেলিকা কাপা কাপা গলায় বললো, আপনি তাদের একজন হলেও আপনি তাদের মতো না। সবাই যখন লুটপাট করছিলো আপনি ঘোড়ার পিঠে চেপে বসে ছিলেন। অন্যের কথা শুনে নেমে ছিলেন। অতঃপর আমাকে দেখে আপনি এগিয়ে ধরতে আসেন নি, বরং অন্য সেনা দেখে ফেলায় আপনি আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন। আপনি আমাকে ভোগ করলেও আমাকে অতি যন্ত্রণা দিবেন বলে মনে হয় নি। তাই অনিরাপদ যায়গায় আপনার কাছেই নিরাপদ বোধ করি।
শঙ্কচন্দ্র জোরে নিশ্বাস ফেলে বললো, বসো এখানে, পহেলিকা তাহার পাশে গিয়ে বসলো।

মন্তব্যসমূহ