চিঠি
প্রচন্ড্র সিগারেটের নেশা ধরেছে। মা ঘরের কাজ করতেছে বিধায় দরজা বন্ধ করে খেতেও পারছি না। এলাকায় বেশ সুনাম রয়েছে আমার। তাই পাবলিক প্লেসে গিয়ে খাওয়াটা নেহাত বেয়াদবি ছাড়া আর কিছু না। ভেবে কুল পাচ্ছিলাম না কোথায় গিয়ে খাওয়া যায়। টয়লেটে গিয়ে খাওয়ার মতো বাজে সভাব নেই আমার। অনেক ভেবে একটা যায়গায় সন্ধান মাথায় এলো। আমাদের বাসা থেকে ঠিক দক্ষিণে একটা পরিতক্ত বাগান বাড়ি আছে। মালিক দেশের বাইরে থাকে বিধায় বাগানটিতে বেশ জঙ্গল হয়েছে। সেই দিকে মানুষের বেশি একটা যাতায়াত নেই বললেই চলে। চারিদিকে ইটের দেওয়াল, মাঝ খানে ছোট একটা পাকা বাড়ি। ভেতরে অবশ্য সাপ খোপের অভাব নেই।উত্তম যায়গায়। লুংগি পড়ে , লুংগির খুটে সিগারেট আর লাইটার টা নিয়ে নিলাম। দেওয়াল টপকে বাগানে ঢুকে গেলাম। বাড়ির দেওয়াল ঘেঁষে হেলান দিয়ে মনের সুখে সিগারেট ধরালাম। আহা কি শান্তি। যেন এগুলো তামাকের ধোয়া নয়, আমার জন্য অক্সিজেন। এমন সময় পায়ের কাছে ইটে ঢাকা পড়া একটা কাগজ দেখতে পেলাম। অর্ধেক টা ইটের নিচে বাকি অর্ধেক টা বাহিরের দিকে। ইট সরিয়ে হাতে নিলাম কাগজ টা। সদ্য নতুন এক কাগজ। মনে হচ্ছে বড় জোর দুই দিন হবে এই কাগজ টা এখানে রাখা হয়েছে। তাহলে এই পরিতক্ত বাগান বাড়িতে মানুষ আসে কি? এটা কিভাবে সম্ভব। ভুতের ভয়ের গুজবে এখানে লোকের যাতায়াত নেই। আমি ভুতের কথায় কান দেই না। এসব কুসংস্কার কে আমি হাসি ঠাট্টার মতই মনে করি। তাহলে ??
কাগজ টা খুলে ফেললাম। সুন্দর সুন্দর হাতের লেখায় বুজতে পারলাম এটা একটা চিঠি। কাউকে দেওয়ার জন্য এখানে রাখা হয়েছে। আমি চিঠি টা খুলে পড়েতে শুরু করলাম।
প্রিয়
আমি বাড়িতে বেশ সমস্যায় পড়েছি। বাবা আমাদের বিষয় টা জানতে পেরেছেন। বাবা খুব রেগে আছেন। তিনি তোমাকে পুলিশের হাতে তুলে দেবেন। আমি খুব কষ্টে আছি প্লিজ আমাকে নিয়ে জাও। আমাকে এই বন্দি জায়গা থেকে নিয়ে জাও। আজ রাতে আমি এই বাগানের কাঠাল গাছের কোনায় দাঁড়িয়ে থাকবো। ঠিক রাত দুটোয় আমাকে নিয়ে যেও। অনথায় তুমি না আসলে আমি গলায় দড়ি দিয়ে মরবো। তবুও বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করবো না।
চিঠি টা শেষ । কাকে লিখা হয়েছে এবং কে লিখেছে তা বুজতে পারলাম না। হয়তোবা আমার এই এলাকার কোন প্রেমকি প্রেমিকা। কিন্তু কে? এই এলাকায় আমার চোখের আড়ালে কিছু হয় না। কোন কিছু হলে সবার আগে আমার কানে কথাটা আসে। তাই অনেকে অবশ্য আমাকে বিবিসি নিউজ এর গভেশক বলেও ডাকে। কেননা সমস্ত খবরাদি আমার কাছে থাকে। কে কাকে পছন্দ করে, কে কোথায় কি করলো, কে ধরা খেলো প্রায় সব কিছুই জানি। কিন্তু এত বড় একটা বিষয় আমার জানা নেই তা কি করে হয়। আজ রাতে দেখা করবে। আর তাদের আমি আজ রাতেই দেখবো যে এরা কে?? যে আমার নাকের ডগা দিয়ে পালিয়ে যাবে আর আমিই জানবো না।
ঘড়িতে এলাম দিয়ে রাখলাম। ঠিক রাত ১.৩০ মিনিট এ উঠে পড়লাম। আস্তে করে দরজা বন্ধ করে সেই বাগানের দিকে হাটতে শুরু করলাম। দেওয়াল টপকে বাগানে ঢুকে পড়লাম। অন্ধকার রাত। চারিদিকে শুনসান। জিজি পোকা আর দুরের শেয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। আর সাথে সাথে রাস্তার এক কুকুর এক বেসুরের বেদনার ডাক দিচ্ছে। ডাক শুনেই গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। আমি ভুতে ভয় পায় না। তবুও আজ মনে কাটা দিয়ে উঠছে। বুকে থুথু দিয়ে সাহসের সাথে সেই কাঠাল কাছের কাছা কাছি গেলাম। দূর থেকে দেখি একটা ছায়া নড়া চড়া করছে। আমি যুবটি মেরে আরেক গাছের কাছে বসে রইলাম। ছায়াটা মেয়ের। তবে মেয়েটা কে তা চিনতে পারছি না। ইচ্ছে করতেছে গিয়ে বলি তুমি কে আর এত রাতে এখানে কি করছো। কিন্তু গেলাম না। ছেলেটা আসুক দুজন কে হাতে নাতেই পাকড়াও করবো। আমার নাকের ডগা দিয়ে পালাবে আর আমি জানবো না। এটা কি কখনো হয়।
ঘড়ির কাটার রাত ২.০০ টা ছেলেটা এখনো আসেনি। এর মদ্ধেই মনে পড়ে গেলো। ছেলেটা আসবেই বা কি ভাবে। চিঠি তো আমি পেয়েছি। ছেলে তো জানেই না যে মেয়েটা আজ তার জন্য অপেক্ষা করছে। এখন সাহসের সাথে মেয়ের সামনে গেলাম। অন্ধকারে মুখ টা একদমি বোজা যাচ্ছে না। আমি যাওয়ার সাথে সাথে সে বলে উঠলো। তুমি এসেছো?? আমি কখন থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। আমি কিছু বললাম না। আস্তে একটা কাশি দিলাম। কারণ এই অন্ধকারে না আমি তাকে দেখতে পারছি না সে আমাকে দেখতে পারছে। দুজনি দুজনের কাছে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছি। সে আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। কি ঠান্ডা তার শরির। বুজতে পারছি না এই গরমের দিনে মানুষের শরির এতো ঠান্ডা হয় কিভাবে।
আস্তে আস্তে আমার মাথায় ঝিম ধরে গেলো। আমি কোথায় কি করছি কিসের জন্য এসেছি তা ভুলে গেছি। আমার সামনে একজন নারী। আর সে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। তার মিষ্টি চুলের গন্ধ আমাকে পাগল করে দিচ্ছে। আমি তার শরীরে ডুবে গেলাম।
সকালে ঘুম ভাংলো। দেখি আমি বাগানে শুনে আছি। কিছুক্ষন বুজতেই পারছিলাম না আমি এখানে কেন?? তারপর আস্তে আস্তে সব মনে পড়ে গেলো। হয়তোবা প্রথম কোন নারীর স্পশে আমি অজ্ঞান হয়ে গেছি। তারপর হাটি হাটি পা পা করে বাসায় চলে গেলাম। মা এখনো ঘুম থেকে উঠেনি। আমি দরজা খুলে রুমে ঢুকে পড়লাম।
সারাটা দিন গেলো সেই রাতের কথা ভেবে। মেয়েটা কে ছিলো। আর আমি অজ্ঞান ই হলাম কিভাবে। এটা জাচাই করার জন্য আবারো বাগানে ঢুকে পড়লাম। আবারো সেই ইটের নিচে একটা চিঠি।
প্রিয়
আমি আজ রাতে আবার আসবো
শেষ। চিঠি এখানেই শেষ। আমরা চিঠি লিখলে ইতি তুমার অমুক তমুক লিখি এখানে তাও নেই। নাম কি তাও জানিনা। জানিনা কাল আমার এলাকার কোন মেয়ের সাথে জড়িয়ে গিয়েছি। আর কেনই বা এমন টা হলো আমার সাথে। বুজে উঠতে পারছিলাম না। এই প্রশ্নের উত্তর আজ রাতেই পাওয়া যাবে।
গত রাতের মতো আজকেও একি সময় উঠে পড়লাম। আবারো সেই বাগানে ঢুকে গেলাম। কালকের মতো আজকেও সেই ছায়ার ঘোরা ঘুরি। তার কাছে গেলাম। আমি মুখ খুলে কিছু বলার আগেই সে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আবারো সেই ঠান্ডা শিতল শরির। মনে হয় এই মাত্র ফ্রিজ থেকে বের হয়ে এসেছে। তার চুলেই সেই আবারো পাগল করে দেওয়ার মতো মিষ্টি গন্ধ। আমি আবারো নেশায় ডুবে যাচ্ছি। কোন মতে তাকে আমার থেকে সরিয়ে নিলাম। কেননা সেই গন্ধে আমার প্রচন্ড্র ঘুমের চাপ দিচ্ছে। তাই হুস না হারিয়ে তাকে দূরে ঠেলে দিলাম।
আমি ঃ এইইই এই মেয়ে তুমি কে???
সে ঃ কেন তুমি কি আমাকে জানো না??
আমি ঃ জানলে কি আর জিজ্ঞেস করি??
সে ঃ আমি তো তোমারি অপেক্ষায় ছিলাম।
আমি ঃ আমার অপেক্ষায় মানে? তুমি জানো আমি কে??
সে ঃ হুম জানি।
আমি ঃ তাহলে?? তুমি কে তা তো আমার জানতে হবে??
সে ঃ সেটা না জানলেও হবে।
আমি ঃ কোথায় থাকো তুমি?? কার মেয়ে??
সে ঃ আমি তো সব সময় এখানেই থাকি।; কেন তুমি জানো না??
নিশ্চিত মেয়েটা পাগল । এই জঙ্গলে সাপ খোপ ছাড়া আর কি আছে। আমি প্রচন্ড্র রেগে গেলাম। কায়দা করে আজ ফোন নিয়ে এসেছিলাম। ফ্লাস তার মুখে ধরেই আমি অবাক হয়ে গেলাম।
এ কি করে এখানে??? এ তো সম্ভব না?? এ কোন ভাবেই সম্ভব না?? আমি নিজের চোখ কেও বিশ্বাস করতে পারছি না। সে বিদ্ঘুটে হাসি দিতে থাকলো। তার হাসিতে কানে তালা লেগে যায়। আমি চিতকার দিতে থাকি। কিন্তু আমার গলা দিয়ে আওয়াজ বের হয় না। আমার শরির প্রচন্ড্র ঘেমে যায়।
তন্ময়ী, সে আমাদের এলাকার ক্রাস বললেই চলে। এমন কোন ছেলে নেই যে তার পিছু না নিয়েছে। তাকে না পছন্দ করেছে। সে খুব চুপচাপ। স্কুলে যাওয়ার সময় তার পরিবারের কেউ না কেউ থাকবো। সে অসম্ভব সুন্দরী ছিলো বিধায় তার জন্য গারডিয়ান রা বডিগাডের দায়িত্তে থাকতো। আমারো বেশ পছন্দের ছিলো। গত ৪ বছর আগে সে মারা যায়। অভ্র নামের এক ছেলের সাথে তার প্রেম ছিলো। ছেলেটা আমার পাশের এলাকায় থাকে। যখন তাদের প্রেমের বিষয় ফাস হয় তখন তন্ময়ীর বাবা বেশ খেপে যায়। হিন্দুদের মাজে জাত পাতের পোকা আছে। তাই ছেলে নিচু জাতের বিধায় মেয়ের বাবা কিছুতেই মেনে নিতে চায় না। অবশেষে ছেলেকে একদিন মারধর করে এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হলো। মেয়েটা অবশ্য জানতো না যে ছেলেটা মার খেয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে। মেয়ের বাবা মুখোপদ্যায় বসু আমার মামাকে ছেলেটাকে হুমকি দেওয়ার জন্য সুপারিশ করে। মামা রাজনিতিবিদ, উনি ব্যস্ত মানুষ বিধায় এ কাজের ভার আমাকে দেওয়া হয়। মেয়ের বাবা আমার পকেটে ৫০০ টাকা নোট গুজে দেয়। আমি বন্ধুদের পাটি দেবো বলে তাদের সাথে নিয়ে ছেলেকে বেদম মারধর করে এলাকা ছাড়া করে দেই। মেয়েটাও ছেলের শোকে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে। আর মেয়ে বাবা মা সেই শোকে এখানে থেকে চলে যায়। সেই থেকে বাড়িটা পরিতক্ত।
এখন আমার কাছে সব মনে পড়ছে। সব বুজতে পারছি। ছেলেটা চিঠি পায়নি। কারন তাকে আমরা মেরে তাড়িয়ে দেই। আর মেয়েটা ভেবেছিলো ছেলেটা তাকে ধোকা দিয়েছে তাই সেই শোকে সে আত্মহত্যা করে। এখনো তার আত্মা এখানে আছে। এই জন্য মানুষ এটাকে ভুতুড়ে বাগান বলে। গল্প শুনেছি যে এখানে গত ৪ বছর জাবত মেয়ে মানুষের কান্নার আওয়াজ শোনা যায়। কিন্তু মেয়েটাকে দেখা যায় না। আমি কখনো কান্নার আওয়াজ শুনিনি তাই এগুলো কথায় কান ও দেই নি।
সে তার হাসি থামাচ্ছে না। এক দমে হেসে যাচ্ছে। তার চোখ লাল আভায় ছেয়ে গেছে। চোখের নিচে কালো কালিতে ভরে গেছে।
আবারো সকাল বেলা ঘুম ভেংগে গেলো। দেখি সেই বাগানেই শুয়ে আছি। আজ বুজতে পারলাম মাত্র ৫০০ টাকার লোভে কত বড় ভুল করে ফেলেছি। একটা পুরো পরিবার আমার জন্য শেষ হয়ে গেছে।
মন্তব্যসমূহ